ঢাকা , মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ই-পেপার

সমাজ গঠনে সরকারী চাকুরে ও সাংবাদপত্রের জবাবদিহিতা

দৈনিক মার্তৃভূমির খবর
আপলোড সময় : ১৭-০৮-২০২৪ ১১:০৬:০১ পূর্বাহ্ন
আপডেট সময় : ১৭-০৮-২০২৪ ০১:৩০:০৭ অপরাহ্ন
সমাজ গঠনে সরকারী চাকুরে ও সাংবাদপত্রের জবাবদিহিতা প্রতীকী ছবি

জবাবদিহিতা- সেটি ব্যক্তিক বা সামষ্টিক, যেটিই হোক, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের অন্যতম প্রধান নিয়ামক। আবহমানকাল থেকে সহাবস্থানের মাধ্যমে মানব-সমাজ সুসংগঠিত, শৃঙ্খলানুগ ও সহযোগিতাপূর্ণ। বিভিন্ন শ্রেণি- পেশার মানুষের সমন্বিত প্রচেষ্টার ফসল আজকের তথ্যপ্রযুক্তির অত্যাধুনিক বিশ্ব।  কোনো পেশা ক্ষুদ্র অথবা অবহেলাযোগ্য নয়। তবে দায়িত্ব ও কর্তব্যের ভিন্নতা বিদ্যমান। সমাজে সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য সমান ও সমান্তরাল না থাকায় সামাজিক স্তর বিন্যাস পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বায়নের যুগে সমাজ ব্যবস্থা অতিদ্রুত পরিবর্তত হচ্ছে। সমাজ ও সংস্কৃতিতে আসছে নানামুখি চ্যালেঞ্জ। তবে সমাজের মূল গাঠনিক উপাদানে পরিবর্তন হয় না। পেশা সংকুচিত হয় কম। প্রযুক্তি কার্যসম্পাদন করছে কিন্তু কর্মশ্রেণি সংকুচিত হচ্ছে না। প্রযুক্তির প্রসারের সাথে সাথে সমাজে কিছু কিছু জবাজদিহিতা সৃষ্টি হলেও সামাজিক দায়বদ্ধতা ও নিরাপত্তা সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। একটি শক্তিশালী ও জনকল্যানমুখি সমাজ গঠনের জন্য ব্যক্তিগত জবাবদিহিতার কোনোই বিকল্প নেই। 


সরকারী কর্মচারী, শিক্ষাবিদ, ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিল্পী, কৃষি কর্মী, সাংবাদিক ইত্যাদি পেশাদার মানুষের জবাবদিহিতা সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের কাজের মাধ্যমেই সরকারি সেবা, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিজ্ঞান, সৃজনশীলতা, খাদ্য সরবরাহ প্রভৃতির সুফল মানুষ পাচ্ছে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ ব্যক্তিগত জবাবদিহিতা অনুভব করেন না বলেই সামাজিক দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয় না। অথচ, পেশাদার জবাবদিহিতার মাধ্যমে সমাজ ন্যায্যতা, সততা, স্বচ্ছতা, ন্যয়-নিষ্ঠার মাধ্যমে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যায়। তাদের কাজ, জবাবদিহিতা, সামাজিক ভাবনা ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ন্যায়নির্ভর সমাজ গঠন সম্ভব।  

 

সরকারী কর্মচারী: সরকারী কর্মচারীরা সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে। এক্ষেত্রে নৈতিক জবাবদিহিতা একান্ত অত্যাবশ্যক। তাদের কর্মের মাধ্যমে সমাজের প্রাথমিক চাহিদা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। তারা ন্যায়পূর্ণ দায়িত্বের প্রতি দায়বদ্ধ হতে এবং আইনানুগ কার্যাবলি সম্পাদনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাদের নব নব উদ্ভাবন ও সেবাসৃষ্টি মানুষের আর্থিক ও সমাজের উন্নতির সুদৃষ্টান্ত। তবে সকলের কাজ অবিসংবাদিত নয়। দুর্নীতি একটি ব্যধি। এটি সংক্রমিত হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংস করে দেয়। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সামাজিক অস্তিরতার সৃষ্টি হয়। এই অনিয়ম-অসংগতি এবং দুর্নীতি থেকে বের হতে গেলে রাষ্ট্রীয় অনুশাসনের থেকেও ব্যক্তিগত জবাবদিহিতা অধিকতর জরুরি। ন্যায়নিষ্ট সাংবাদিকবান্ধব জনকল্যাণমূলক জনপ্রশাসন সবার প্রত্যাশা। এক্ষেত্রেও পারস্পারিক জবাবদিহিতা অত্যন্ত গুরুত্ববহ।


সাংবাদিক: সাংবাদিকগণ সমাজের চোখ হিসেবে কাজ করেন। তারা সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে সত্যনিষ্ঠ বিষয় কলমের তুলিতে তুলে আনেন।  তারা সত্যের পক্ষে ওকালতি এবং মিথ্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং সামগ্রিকভাবে সমাজের জন্য জরুরি তথ্য উপস্থাপন করেন। তবে তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের কারণে সাংবাদিকতা এখন অনেকক্ষেত্রেই বিসংবাদিত। একটি এনড্রয়েড মোবাইল সেট হাতে পেলেই কেউ কেউ সাংবাদিক হয়ে ওঠেন। এতে সমাজ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বহুলাংশে বর্জিত অপতথ্যসম্বলিত মিথ্যা সংবাদের গর্জন সমাজকে চোখ রাঙানি দেয়। ‘দুঃসংবাদ বাতাসের বেগে ধায়’ এই বিরুপ ও বিকৃত প্রচারের সুযোগ গ্রহণ করে অনেকেই সমাজকে ব্লাকমেইল করছে। এটি বন্ধ হওয়া জরুরি। ‘অসির চেয়ে মসি বড়’ এই চিন্তা থেকে অনেকে গুন্ডামীও করেন। তখন সত্যি সত্যি মনে হয় তাদের হাতে কলম নয় বরং আগ্নেয়াস্ত্র। মনে রাখতে হবে কলম পারমাণবিক বোমার চেয়ে শক্তিশালী। মাস্তানী করে সেই ক্ষমতাকে খর্ব করতে নেই। ব্যক্তিগত স্বচ্ছতা, সততা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেই শক্তিশালী লেখনিই সমাজ বদলে দিতে পারে। মিথ্যা দিয়ে মিথ্যার প্রতিরোধ অসম্ভব। 


জনসেবা ও সাংবাদিকের সম্পর্ক: জনসেবা ও সাংবাদিকের সম্পর্ক চিরন্তন। জনসেবা বিঘ্নিত হলে সৎসাংবাদিক গর্জে উঠবেন। এটিই স্বাভাবিক। সমাজের মৌলিক অধিকার ও ন্যায়ের প্রতি একনিষ্ঠতা সরকারী কর্মচারী ও সাংবাদিকের এক ও অভিন্ন কাজ। গঠনমূলক সমলোচনাই সুস্থ সমাজ গঠনে সক্ষম। সৎসাংবাদিকগণ পেশাগত নৈতিকতা এবং দৈনিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সমাজের চোখ এবং কান হিসেবে সদাজাগ্রত থাকে।


ফেসবুক ইউটিউব ও সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলির মধ্যে এখন সবচেয়ে প্রভাবশালী অবস্থানে রয়েছে ইউটিউব। এনড্রয়েড সেটের সহজলভ্যতার কারণে সংবাদপত্র গুরুত্ব হারিয়েছে। সঠিকতা, সত্যতা ও বাস্তবতা মূল্যায়ন না করেই ইউটিউবে প্রচুর অপপ্রচার করা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। ভুল মানুষের বিবিধ ভুল ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত মিথ্যা কন্টেন্টের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বস্তুনিষ্টতা এখন বহুলাংশে প্রশ্নবিদ্ধ। 


সাইবার বুলিং
সাইবার বুলিং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অভিশাপ। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যক্তিগত ঘৃণা, বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় বিভেদ, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, ঈর্ষার প্রকাশ ঘটছে অহরহ। বিভিন্ন বিষয়ে অপপ্রচার চলছে, যা সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করছে ও বিশ্বাসের মূলে আঘাত হানছে। সাইবার বুলিং এখন প্রযুক্তির ব্যধি। এই সংক্রামক ব্যধি সমাজকে আক্রান্ত করছে সবচেয়ে বেশি। সাইবার বুলিং থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে যেমন প্রয়োজন আইনের প্রবল প্রয়োগ তেমনি প্রয়োজন সংবাদপত্রের বলিষ্ট অবস্থান। নিরপেক্ষ সাংবাদিকতাই পারে মানুষকে সার্বিকভাবে সচেতন করতে। 


মুক্ত ও নিষ্পাপ প্রকাশে যৌক্তিক যুক্ততা: সরকারী কর্মচারী এবং সাংবাদিকগণ তাদের কর্মযজ্ঞের মুক্ত ও নিষ্পাপ প্রকাশের জন্য যৌক্তিকভাবে সংযুক্ত। তারা সত্যের পক্ষে এবং মিথ্যা ও হঠকারিতার বিরুদ্ধে। উভয় পেশার দায়িত্ববানগণ সঠিক ও তথ্যমূলক প্রতিবেদন প্রদান করে। তাদের দ্বারা সমাজের জনগণ বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহী এবং সঠিক তথ্য প্রাপ্ত হয়। সব শ্রেণিপেশার মানুষের নানামুখী অবদানের সাথে সাথে সরকারী কর্মচারী এবং সাংবাদিকগণ সমাজের নির্মাতা। এই দুই প্রধান শ্রেণীর ব্যক্তিগত জবাবদিহিতাই দিতে পারে একটি মানবিক, অসাম্প্রদায়িক এবং ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ গঠনের নিশ্চয়তা।   

       
সমাজে সকলের দায়িত্ব রয়েছে। কারও বেশি, কারও কম। তবে সব দায়িত্বই গুরুত্বপূর্ণ। সবাই কোনো না কোনোভাবে অন্যের উপর নির্ভরশীল। সমাজ প্রতিনিয়ত প্রবিধ সমস্যা মোকাবেলা করে। নিত্যনতুন সমস্যায় আক্রান্ত সমাজের নবতম সমস্যা তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার। এই অপব্যবহার রোধে সরকারি চাকুরে ও সাংবাদিকের ভূমিকা অগ্রগণ্য। সরকারি চাকুরে নির্লোভ ও সৎ এবং সংবাদপত্র নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ট হলেই সব সমস্যার সমাধান সম্ভব।

 

লেখকঃ ড. হাফিজ রহমান, বিশ্লেষক ও সংস্কৃতি কর্মী 

 

 

 


নিউজটি আপডেট করেছেন : Matribhumir Khobor

কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ